ঢাকার বসিলায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বিক্রির একটি দোকান। নাম নোমান অটো। দোকানের ভেতরে ও বাইরে চকচকে নতুন কয়েকটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রাখা আছে বিক্রির জন্য। হুট করে দেখলে এটাকে শুধু বিক্রয়কেন্দ্র বলেই মনে হবে। তবে বাস্তবে এটি একটি ওয়ার্কশপও।
ওয়ার্কশপের মালিক তৈয়ব হোসেনকে নিয়ে দোকানের পেছনের অংশে গিয়ে দেখা যায় বেশ বড় জায়গা জুড়ে চলছে রিকশা বানানোর কাজ।
লোহার তৈরি রিকশার কাঠামো, চাকা, ব্যাটারি, মোটর সবই আছে ভেতরে।
কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন ঝালাইয়ের।
“ব্যাটারি-মোটর লাগিয়ে একটা রিকশা তৈরি করতে আমাদের খরচ হয় ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকা। এটা আমরা পাঁচ/ছয় হাজার টাকা লাভে বিক্রি করি,” বলছিলেন নোমান অটোর মালিক তৈয়ব হোসেন।
কিন্তু রিকশা বানানোর যেসব উপকরণ সেগুলো তারা কোথায় পান–– এমন প্রশ্নে তৈয়ব হোসেন জানান, এগুলো তারা সংগ্রহ করেন খোলা বাজার থেকে।
তিনি বলেন, “এখানে মোটর আছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন পার্টস আছে, যেমন হর্ন, ব্রেক সিস্টেম ইত্যাদি। এগুলো সব চাইনিজ। এগুলো আমদানি হয়। এর সঙ্গে চাকা, বসার সিট, রিকশার বডি -এগুলোই আমরা বিভিন্ন দোকান থেকে কিনে আনি। আমার ওয়ার্কশপে শুধু ফিটিং হয়। এরপর পুরো রিকশাটা তৈরি করে আমরা বিক্রি করি।”
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নোমান অটোর মতো অসংখ্য ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। রাস্তার পাশে ছোট্ট দোকান থেকে শুরু করে বাড়ির গ্যারেজ––বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের ওয়ার্কশপ থেকে অটোরিকশা তৈরি হচ্ছে। আর শহরগুলোর রাস্তা-ঘাট ছেয়ে যাচ্ছে নানান আকারের অটোরিকশায়।
যানজট আর দুর্ঘটনার ঝুঁকির মুখে অবৈধ এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে নানা উদ্যোগের মধ্যে দেশটির সরকার কয়েকবার এই বাহনটির চলাচল বন্ধের চেষ্টা করলেও সফল হয়নি।
চালকদের প্রতিবাদের মুখে প্রতিবারই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে।
কিন্তু ঢাকাসহ সারা দেশেই যেভাবে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার এই যানবাহন ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে করে বার বার প্রশ্ন উঠছে–– কেন এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি হয় না বাংলাদেশে। এগুলো দেশেই তৈরি হয় দেশীয় কারিগরদের হাতে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকার মোহাম্মদপুর, বসিলা, কেরাণীগঞ্জ, বেড়িবাঁধ, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়, মূলত পাড়া-মহল্লাগুলোয় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য ওয়ার্কশপ।
এগুলো থেকেই প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত শত অটোরিকশা।
বছর দুয়েক ধরে রিকশাচালকদের মধ্যে অটোরিকশার চাহিদা বাড়তে থাকলে ওয়ার্কশপগুলো তৈরি হতে থাকে। এসব অটোরিকশায় পরিশ্রম কম, আয় বেশি। ফলে রিকশাচালক ছাড়াও অন্যান্য পেশার লোকজনও অটোরিকশা চালানো শুরু করেন।
বিপুল চাহিদা মেটাতে ওয়ার্কশপের সংখ্যাও বাড়ে। একেক ওয়ার্কশপে তৈরি হতে থাকে একেক ধরনের অটোরিকশা।
কোনোটি চিকন চাকার, কোনোটির চাকা মোটা। কোনোটির কাঠামো লোহার, কোনোটিতে লোহার কাঠামোর সঙ্গে ওপরে বেতের ছাউনি।
কোনোটি শুধু পায়ে চালিত রিকশার মধ্যেই মোটর লাগিয়ে অটোতে রূপান্তর করা হয়েছে, কোনোটিতে আবার কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে।
এসব রিকশা সঙ্গে ঢাকার বাইরে থেকেও বিপুল পরিমাণে রিকশা ঢুকেছে ঢাকায়।
বাংলাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অবৈধ।
ফলে এই অবৈধ যানবাহন যখন পাড়া-মহল্লার রাস্তা পেরিয়ে মূল সড়কে একের পর এক উঠে আসতে শুরু করে তখন এটা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, কিন্তু দুরন্ত গতি। ফলাফল সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা।
ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার গত এক বছরে অন্তত দু’বার অটোরিকশা বন্ধের চেষ্টা করে।
কিন্তু অটোরিকশা নিষিদ্ধের চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়।
কারণ, এর বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যায় চালকরা নেমে এসেছিলেন রাস্তায়।
সেসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মূলত সড়কে অটোরিকশা উঠতে না দেয়া কিংবা জব্দ করার মতো পদক্ষেপ নেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চালকেরা।
কিন্তু যেখান থেকে অটোরিকশাগুলো বানানো হয়, সেই ওয়ার্কশপগুলোতে কোনো নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
খালেক মন্ডল নামে একজন চালক বিবিসি বাংলাকে বলেন, অটোরিকশা বন্ধের চেষ্টা হলে আবারও প্রতিবাদ হবে।
তিনি বলেন, “আমি তো এই অটো কিনেছি ঋণ করে। সরকার হঠাৎ কেন বন্ধ করবে? আমি ঋণ কীভাবে শোধ করবো? সরকার তো আগে ছয় মাস বা একবছর সময় দিবে! সরকার আগে গোড়ায় হাত দিক। মোটর আমদানি বন্ধ করুক। আমদানি বন্ধ করলে তো এমনিতেই রিকশা বানানো বন্ধ হয়ে যাবে! কারখানাগুলোতে অভিযান করুক।”
মন্তব্য করুন