সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমানো নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে বাংলাদেশ। বাণিজ্যের বাইরেও রয়েছে জটিল সব শর্ত। সেসব শর্তের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শর্তগুলো কি – তা প্রকাশ না করলেও বৈঠক সূত্রে কিছু বিষয়ের আভাস মিলেছে।
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে আরও কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা করবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ওই আলোচনার প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে বৈঠক হয়েছে দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। সবার মতামত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ।
প্রস্তুতি হিসেবে বুধবার (১৬ জুলাই) একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অর্থ, কৃষি, খাদ্য, পরিবেশ, জ্বালানিসহ ১১ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন ঐ বৈঠকে। এছাড়াও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা। এখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই এমন আন্তঃবৈঠক চলতে থাকবে। যেখান থেকেই বাংলাদেশের কাছে চাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা ও তাদের দেওয়া শর্ত কতটুকু মানা সম্ভব তা নির্ধারণ করবেন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাণিজ্য প্রতিনিধিরা। এরপর বেশি স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যদের পরামর্শ নেওয়া হবে বলে জানা যায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার সময় চাওয়া হয়েছে। পরবর্তী বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এখনো ওই বৈঠকের চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা এখনো নির্দিষ্ট সময় দেয়নি। আমরা যোগাযোগ করছি, আগামী সপ্তাহের মধ্যে এ বৈঠক হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক কমানোর জন্য যেসব শর্ত দিচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে খুব বেশি পরিষ্কার কিছু জানাচ্ছে না সরকার। আজকের বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের (গোপনীয় চুক্তি) কারণে দর-কষাকষি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
বৈঠক শেষে বাণিজ্য সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে শুল্ক আলোচনা চলছে, সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো রয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামতগুলো আমাদের নিতে হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামতের বিষয়ে একটা প্রস্তাবনা নিয়ে আবার চূড়ান্ত আলোচনা হবে।
কোন কোন বিষয়ে আলোচনায় প্রধান্য পেয়েছে সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো জবাব দেননি সচিব। তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি করে থাকি। সেগুলোর বিষয়ে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে কিছু আইন-কানুন রয়েছে। সেসব আইন সম্পর্কে তাদের ব্যবস্থাপনা কী, তারা কীভাবে কী করছে, সেগুলো জানতে চাওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে একমত হলেও বাণিজ্যের বাইরের বিষয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দর-কষাকষি আটকে আছে। এর মধ্যে এমন কিছু স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের জন্য মানা খুব কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে ব্যবসা বাড়ানোর সঙ্গে চীনসহ অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে ব্যবসায় নিরুৎসাহিত করতে চায়। রয়েছে বাংলাদেশের আরও কিছু অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করার মতো শর্তের আভাস। যে বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে বেশি না ঝোঁকে।
জানা যায়, কিছু শর্ত এমন রয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে একই সুবিধা না দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
রয়েছে আরও কঠিন সব শর্ত
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, জ্বালানি, খাদ্যশস্য ও সামরিক পণ্য আমদানিতে নানা সুবিধা চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশের বেশ কিছু শিল্প, বন্দর পরিচালনা ও প্রযুক্তি পণ্যে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোও রয়েছে শর্তে। বাংলাদেশের সঙ্গে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, কৃষি, মোটরগাড়ি ও যন্ত্রাংশ ব্যবসায় নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধা দূর করতে শর্ত দিয়েছে।
শর্ত বিষয়ে ব্যবসায়ীরাও পরিস্কার নয়,
চলমান শুল্ক জটিলতা নিয়ে এর আগে বৈঠক করা হয়েছে দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
তারা জানান, বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের কাছে এই শুল্ক ইস্যুতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। তবে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া এবং শর্তগুলো কী তা জানতে চাইলে ‘নন-ডিসক্লোজার’ ইস্যু তুলে এ বিষয়ে তাদেরও কিছু বলা হয়নি।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাণিজ্যের বাইরেও এখন এ শুল্ক চুক্তিতে অনেক বিষয় রয়েছে। সেগুলো কঠিন। ফলে সরকার একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।’
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা যেটুকু বুঝতে পারছি, শুল্ক ইস্যুটি এখন সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। অনেক বিষয় সরকার ডিসক্লোজ (প্রকাশ) করতে পারছে না। তবে যেটা উঠে এসেছে, সরকার দেশ ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট নানা শর্ত দিচ্ছে, যেগুলো বাংলাদেশের জন্য কঠিন। যদিও তাদের সঙ্গেই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা।’
মন্তব্য করুন